চব্বিশের ১৯ জুলাই। ছাত্র-জনতার আন্দোলন রূপ নেয় ভয়াবহ অগ্নিশিখায়। সারাদিনব্যাপী সংঘর্ষে এদিন দেশজুড়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০ জনে। ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বাস্তবায়নে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে ছাত্র-জনতা। বুলেটের জবাবে উত্তাল গোটা দেশ। আন্দোলন দমনে মরিয়া হয়ে ওঠে স্বৈরাচার। ক্ষমতা ধরে রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের দেওয়া হয় সর্বোচ্চ নির্দেশনা। এমনকি হেলিকপ্টার থেকেও গুলি চালানো হয়। রাজধানী ঢাকা রূপ নেয় এক বিভীষিকার নগরীতে। রাত ১২টা থেকে জারি করা হয় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ।
ঢাকার বাতাসে বারুদের গন্ধ, টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় শ্বাস নেওয়া কঠিন। শহরের সড়কগুলো যেন এক একটি ধ্বংসস্তূপ। রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, নিউমার্কেট, কুড়িল, মহাখালী, উত্তরা—প্রতিটি এলাকায় একই চিত্র।
আন্দোলনকারীদের রাজপথ থেকে হটাতে পুলিশের আচরণ হয়ে ওঠে বেপরোয়া। নির্বিচারে ছোড়া হয় গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল। রাজধানী পরিণত হয় আতঙ্ক, উৎকণ্ঠা আর গুজবের শহরে।
গুলশান-১ এলাকায় ইটপাটকেল নিক্ষেপের পর দুটি বেসরকারি ভবনে ভাঙচুর চালানো হয়। মহাখালীতে আন্দোলনকারীরা রেল ও সড়ক অবরোধ করে দুটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। নিউমার্কেট এলাকায় পুড়িয়ে দেওয়া হয় একটি পুলিশ ফাঁড়ি।
সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয় যাত্রাবাড়ীতে। সারাদিন পুলিশ-বিজিবির সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় কেঁপে উঠে এলাকা। হতাহতের খবর পাওয়া যায়। তবে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংঘর্ষও হয় আরও তীব্র। থেমে থেমে চলতে থাকে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। বন্ধ হয়ে যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যান চলাচল। একই সময়ে হামলার শিকার হয় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভি ভবন।
মালিবাগ রেলগেট থেকে রামপুরা বিটিভি ভবন পর্যন্ত পুরো সড়কে অবস্থান নেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের মৃত্যুর প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে তারা।
এ সময় সারাদেশ থেকে হতাহতের খবর আসতে শুরু করলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ঘরে বসে থাকেনি। জীবনকে তুচ্ছ করে তারা যুক্ত হন রাজপথের আন্দোলনে। আন্দোলন দমাতে কুড়িলে হেলিকপ্টার থেকে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে র্যাব। ছোড়ে সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি।
উত্তরার বিভিন্ন পয়েন্টেও ব্যাপক সংঘর্ষ হয়, যাতে বহু মানুষ হতাহত হন। রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকাতেও পুলিশের সঙ্গে একটি দলের সংঘর্ষ দিনভর চলতে থাকে।
সকালে একের পর এক মরদেহ পৌঁছাতে থাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। নিহত ৩০ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি—৫ জনের মৃত্যু হয় যাত্রাবাড়ীতে। শতাধিক আহত ব্যক্তি ভর্তি হন ঢামেকে, বাকিরা যান শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে, অনেকে আবার গোপনে চিকিৎসা নেন।
সংঘর্ষের মাঝেই ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন—সকল বিশৃঙ্খলাকারী ও তাদের সহায়তাকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অভিযোগ করেন—বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনে সম্পৃক্ত, শেখ হাসিনা বাধ্য হয়ে গুলি ও কারফিউর নির্দেশ দিয়েছেন। অপরদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন—সরকার নিজেই দায়ী, শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন এখন রাষ্ট্র সংস্কারের আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে।
সকালে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ‘সন্তানের পাশে অভিভাবক’ ব্যানারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন অভিভাবকেরা। অনেকেই শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি করেন। রাজধানীজুড়ে বন্ধ ছিল ইন্টারনেট ও যান চলাচল। মোটরসাইকেল চলাচলেও জারি করা হয় নিষেধাজ্ঞা।
রাত ১২টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ ঘোষণা করে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেদিন গণভবনে ১৪ দলের সঙ্গে বৈঠকের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জানান—প্রধানমন্ত্রী সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রাতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শুরু করে কারফিউ ও সেনা মোতায়েনের প্রস্তুতি।