গত বছর শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে হওয়া আন্দোলন দমন করতে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই দিয়েছিলেন—সম্প্রতি বিবিসির যাচাই করা একটি কথোপকথনের অডিও ফাঁস হওয়ার পর, এবার একই ইস্যুতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারবিরোধী শিক্ষার্থী বিক্ষোভ দমন করতে ‘যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই গুলি চালাতে’ নির্দেশ দিয়েছিলেন। আল জাজিরা দাবি করেছে, তারা ওই গোপন ফোনকলের রেকর্ডিং প্রকাশ করেছে এবং ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় ভয়েস ম্যাচিং করে সংশ্লিষ্টদের সনাক্ত করেছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তথ্যমতে, কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা বিক্ষোভ ও দমন-পীড়নে প্রায় ১,৪০০ জন নিহত ও ২০ হাজারেরও বেশি আহত হন। এরপর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান।
‘আমি গোপন নির্দেশ দিয়েছি’
১৮ জুলাই এনটিএমসি’র রেকর্ড করা এক কলালাপে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়:
“আমার নির্দেশ ইতোমধ্যেই দেওয়া হয়েছে। আমি সম্পূর্ণ উন্মুক্ত নির্দেশ জারি করেছি। এখন তারা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করবে, যেখানেই পাবে সেখানেই গুলি করবে… আমি ছাত্রদের নিরাপত্তার কথা ভাবছিলাম।”
আরেকটি ফোনালাপে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে হাসিনা বলেন:
“যেখানেই তারা কোনো সমাবেশ দেখতে পায়, তা উপর থেকে—এটি ইতোমধ্যেই কয়েকটি জায়গায় শুরু হয়েছে। কিছু (বিক্ষোভকারী) সরে গেছে।”
হেলিকপ্টার থেকে গুলি?
পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক শাবির শরীফ জানিয়েছেন, হাসপাতালের প্রবেশপথ লক্ষ্য করে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানো হয়। তিনি বলেন:
“গুলিগুলো কাঁধ বা বুকে ঢুকেছে এবং শরীরের ভেতরেই থেকে গেছে। এক্স-রেতে বিশাল গুলি দেখা গেছে।”
আল জাজিরা গুলির ধরণ যাচাই করতে না পারলেও চিকিৎসকদের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ
এইসব তথ্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। ১০ জুলাই হাসিনা, তার দুই সহযোগী ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয় এবং আগস্টে বিচার শুরু হওয়ার কথা।
প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন:
“তিনি জানতেন তাঁর কথা রেকর্ড হচ্ছে। একাধিকবার অন্য পক্ষ ফোনে আলোচনা করতে না চাইলেও হাসিনা বলেন—‘আমি জানি, রেকর্ড হচ্ছে, কোনো সমস্যা নেই।’”
কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন
২০২৪ সালের জুনে হাইকোর্টের এক রায়ে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল হলে, শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে। তাদের অভিযোগ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের নামে বরাদ্দ কোটার অপব্যবহার করে ক্ষমতাসীন দল নিজেদের লোকদের চাকরি দিচ্ছে।
১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদ নামে এক বিক্ষোভকারী পুলিশের গুলিতে নিহত হন। তার মৃত্যুই আন্দোলনে বড় বাঁক আনে।
সাঈদের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট নিয়ে প্রভাব খাটানোর অভিযোগও তুলেছে আল জাজিরা। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক রাজিবুল ইসলাম জানান, পুলিশ তাকে রিপোর্ট পাঁচবার পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে।
হাসিনার মুখোমুখি নিহতদের পরিবার
সাঈদের মৃত্যু পর, তার পরিবারসহ মোট ৪০টি পরিবারকে ঢাকায় এনে হাসিনার সঙ্গে একটি টিভি প্রোগ্রামে হাজির করানো হয়। নিহত সাঈদের বোন সুমি খাতুন সেদিন বলেন:
“ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশ তাকে গুলি করেছে। এখানে তদন্তের কী আছে? এখানে আসাটা ভুল ছিল।”
তাদের একজন জানান, না গেলে হয়তো সরকারিভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হতো।
আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া
আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র আল জাজিরাকে বলেন, শেখ হাসিনা কখনো ‘মারাত্মক অস্ত্র’ বা প্রাণঘাতী শক্তির অনুমোদন দেননি। রেকর্ডিং ‘সাজানো অথবা সম্পাদিত’ বলে দাবি করেন তিনি।
সূত্র: আল জাজিরা