এ.এইচ.এম. কনক ⚫
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হল দূরপাল্লার একটি অস্ত্র যা বাঁকা গতিপথ অনুসরণ করে নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। এটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়, যার ওয়ারহেড নির্দিষ্ট বস্তু বা স্থাপনা ধ্বংসে প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক বহনে সক্ষম।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা এবং জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর হামলার প্রতিক্রিয়ায় দেশটি ইসরায়েলের দিকে শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। এর মধ্যে কিছু কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতেও সক্ষম হয়েছে।
যদিও ইসরায়েল ইরানের ছোঁড়া অনেক ক্ষেপণাস্ত্র তাদের ‘আয়রন ডোম’-এর মাধ্যমে প্রতিহত করেছে বলে দাবি করেছে, তবে বেশ কয়েকটি তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে ফেলে ভূমিতে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। এর ফলে তেল আবিব, বন্দর নগরী হাইফাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধন হয়েছে। সেইসাথে হতাহত হয়েছে বহু ইসরায়েলি।
যদিও ইরানের কাছে ঠিক কতগুলো ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে তা স্পষ্ট নয়, তবে তাদের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো যে এই অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত এবং অপ্রতিরোধ্য, তা সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সহজেই অনুমান করা যায়।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কীভাবে কাজ করে?
ব্যালিস্টিক মিসাইল সাধারণত তিনটি ধাপে কাজ করে:
- বুস্ট ফেজ:
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রথমে শক্তিশালী রকেট ইঞ্জিন ব্যবহার করে উৎক্ষেপণ করা হয়, যা অবিশ্বাস্যভাবে উচ্চ গতিতে বায়ুমণ্ডল ভেদ করে মহাকাশের দিকে ছুটে যায়। - মিডকোর্স ফেজ:
এরপর ইঞ্জিনগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং ক্ষেপণাস্ত্রটি একটি পূর্বনির্ধারিত পথ অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে থাকে। এটি সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের ধাপ। - টার্মিনাল ফেজ:
এরপর মিসাইলটি আবার খাড়াভাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে।
ব্যালিস্টিক মিসাইল কতদূর যেতে পারে?
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মহাদেশ জুড়ে কয়েকশ কিলোমিটার থেকে শুরু করে ১০ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। এগুলো মূলত পাল্লার ভিত্তিতে শ্রেণিবদ্ধ হয়:
- যুদ্ধক্ষেত্রের পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (BRBM):
২০০ কিমি-এর কম। - স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (SRBM):
১,০০০ কিমি-এর কম। - মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (MRBM/IRBM):
১,০০০-৩,৫০০ কিমি। - দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (LRBM):
৩,৫০০-৫,৫০০ কিমি। - আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (ICBM):
৫,৫০০ কিমি-এর বেশি।
ব্যালিস্টিক মিসাইল কত গতিতে পৌঁছাতে পারে?
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো খুব উচ্চ গতিতে চলে এবং কয়েক মিনিটেই হাজার হাজার কিলোমিটার অতিক্রম করতে পারে। এদের গতি “ম্যাক” এককে প্রকাশ করা হয় (যেখানে ম্যাক ১ = শব্দের গতি)।
- স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র:
সাধারণত সুপারসনিক (ম্যাক ১-এর চেয়ে বেশি), অর্থাৎ ঘণ্টায় ~১,২২৫ কিমি (৭৬১ মাইল)। - দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র:
হাইপারসনিক গতিতে, ম্যাক ৫-এর বেশি (~৬,১২৫ কিমি/ঘণ্টা বা ৩,৮০৬ মাইল/ঘণ্টা)।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলে পৌঁছাতে কত সময় লাগে?
ইরান-ইসরায়েল দূরত্ব প্রায় ১,৩০০-১,৫০০ কিমি। ম্যাক ৫ গতির একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এই দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে মাত্র ১২ মিনিটে। তবে সঠিক সময় নির্ভর করে মিসাইলের ধরণ ও উৎক্ষেপণের স্থান অনুযায়ী।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বাধা দেওয়া কঠিন কেন?
এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো উচ্চ গতি এবং উচ্চতায় চলার কারণে সনাক্ত করা এবং থামানো খুব কঠিন। রাডার ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা এবং দ্রুত বায়ুমণ্ডলে পুনঃপ্রবেশের কারণে সেগুলোকে প্রতিহত করা অনেক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পক্ষেই সম্ভব নয়।
ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের পার্থক্য
- ব্যালিস্টিক মিসাইল:
উচ্চ গতিতে মহাকাশ হয়ে বাঁকা পথে যায়। অনেক দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। - ক্রুজ মিসাইল:
নিচু এবং ধীরে উড়ে যায়, কিন্তু সনাক্ত করা কঠিন।
ইরান থেকে:
- ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র: ~১২ মিনিটে ইসরায়েল।
- ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র: ~২ ঘণ্টা।
- ড্রোন: ~৯ ঘণ্টা।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডার
গত ৩০ বছরে ইরান নিজস্ব প্রযুক্তিতে নানা শ্রেণির ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে। এই ভাণ্ডারে রয়েছে এমন অস্ত্র যা মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে পারে।
ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
ইসরায়েল আমেরিকার সহায়তায় একটি শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র অস্ত্রাগার গড়ে তুলেছে। এদের ‘আয়রন ডোম’ সিস্টেম মাঝারি ও দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে সক্ষম হলেও দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক বা আইসিবিএম প্রতিরোধে এটি কতটা কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
তথ্যসূত্র: আলজাজিরা